বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণ। বিদ্যা ও সংগীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনার মধ্যে দিয়ে বাঙালির প্রতি পরিচিত ঐতিহ্যমন্ডিত হয়। মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা করা হয়। তিথিটি শ্রী পঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামে পরিচিত।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্র-ছাত্রীদের গৃহ ও সার্বজনীন পূজা মন্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়। অনেক হিন্দু পরিবার এই দিনে শিশুর হাতে খড়ি দেন, এই রীতির মধ্য দিয়ে শিশুর পাঠ্যশিক্ষা আরম্ভ করেন। সরস্বতী পূজার দিন প্রভাতের শুভ লগ্নে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সার্বজনীন পূজা মন্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করেন। এই দিনে পূজা মন্ডপ গুলিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পূজার পরদিন অরন্ধন পালন করা হয়।
পূজার নিয়ম
বসন্ত পঞ্চমীর দিন মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা করা হয়। সরস্বতী পূজার জন্য বিশেষ কিছু উপাচার প্রয়োজন- অভ্র- আবির, আমের মুকুল, দোয়াত- কলম ও যবের শিষ । পূজার জন্য দেবীর প্রিয় পলাশ ফুল, বাসন্তী রংয়ের গাঁদা ফুলের প্রয়োজন হয় বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজাতে লেখনি মস্যাধার (দোয়াত- কলম) পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রের ও পূজা করার প্রথা প্রচলিত আছে। দেবী সরস্বতীর কাছে হাতে খড়ি দিয়ে শিশুর পাঠ্যজীবন শুরু হয়। পূজান্তে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীরা দল বেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায় । লোকাচার অনুসারে ছাত্র-ছাত্রীরা পূজার পূর্বে কূল ভক্ষণ করে না । দেবী সরস্বতীকে পূজার দিন কুল পূজা দিয়ে সেই ফলপ্রসাদ হিসেবে খান।
সরস্বতী পূজার মন্ত্র
বঙ্গভূমে শ্রী শ্রী সরস্বতী পুষ্পাঞ্জলি-মন্ত্র —
ওঁ জয় জয় দেবি চরাচরসারে, কুচযুগশোভিতমুক্তাহারে
বীণাপুস্তকরঞ্জিতহস্তে, ভগবতি ভারতি দেবি নমস্তে॥
ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ॥
এষ সচন্দনপুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলিঃ ঐং সরস্বত্যৈ নমঃ॥
প্রণাম-মন্ত্র:
সরস্বতি মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোঽস্তু তে॥
জয় জয় দেবি চরাচরসারে, কুচযুগশোভিতমুক্তাহারে।বীণাপুস্তকরঞ্জিতহস্তে, ভগবতি ভারতি দেবি নমস্তে॥
সরস্বতীর স্তবঃ
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা॥
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা॥
বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈরর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ।
পূজিতা মুনিভিঃ সর্ব্বৈর্ ঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা॥
স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রীং সরস্বতীম্।
যে স্মরন্তি ত্রিসন্ধ্যায়াং সর্ব্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে॥
দেবী সরস্বতীর নামের অর্থ
সরস্ + বতী- সরস্ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হ্রদ বা সরোবর হলেও এটির আক্ষরিক অর্থ “বাক্য”। বতী শব্দের অর্থ- যিনি অধিষ্ঠাত্রী । সরস্বতী নামের অর্থ হল “যে দেবী পুষ্করণী, হ্রদ বা সরোবরের অধিকারিণী” বা ক্ষেত্রবিশেষে “যে দেবী বাক্যের অধিকারিনী” । অপর ব্যাখ্যা অনুযায়ী- “সর” শব্দের অর্থ ‘সার’ বা ‘নির্যাস’ এবং স্ব শব্দের অর্থ- আত্মা। এই অর্থ ধরলে- ‘সরস্বতী’ নামের অর্থ দাঁড়ায়- যিনি আত্মার সার উপলব্ধি করতে সহায়তা করেন অথবা যিনি (পরব্রক্ষের) সার ব্যক্তির আত্মার সঙ্গে মিলিত করেন ।
সরস্বতীর অপর নাম
প্রাচীন হিন্দু সাহিত্যে সরস্বতী নানা নামে পরিচিত ব্রাহ্মণী (ব্রহ্মার শক্তি), ব্রাক্ষী (বিজ্ঞানের দেবী), ভারতী (ইতিহাসে দেবী), বানেশ্বরী (অক্ষরের দেবী), কবিজিহ্বাগ্রবাসিনী (যিনি কবিগনের জিহ্বাগ্রে বাস করেন) । আবার সরস্বতী রূপ বর্ণানুসারে দেবী কয়েকটি নাম হলো- সরস্বতী বিদ্যাদাত্রী (যিনি বিদ্যা দান করেন)। বীণাবাদিনী (যিনি বীণা বাজান), পুস্তকধারিণী (যিনি হস্তে পুস্তক ধারণ করেন)। বীণাপানী (যার হাতে বীণা শোভা পায়)। হংসবাহিনী (যে দেবীর বাহন রাজহংস) ও বাগদেবী (বাক্যের দেবী) নামে পরিচিত।
অন্যান্য নামগুলির মধ্যে রয়েছে অম্বিকা, ভারতী, চন্দ্রিকা, দেবী গোমতী, হামশাসন, সৌদামিনী, শ্বেতাম্বরা, সুভদ্রা, বৈষ্ণবী, বসুধা, বিদ্যা, বিদ্যারুপা, এবং বিন্ধ্যাবাসিনী।
দেবীর জন্ম রহস্য
- পশ্চিমবঙ্গ সহ পূর্ব ভারতের অনেক জায়গাতেই দেবী সরস্বতীকে শিব পার্বতীর কন্যা বলে মনে করেন।
- পুরান অনুসারে বসন্ত পঞ্চমীর দিন ব্রহ্মার মুখ গব্বর থেকে সরস্বতীর জন্ম হয়। সকল শব্দ ও ভাষার উৎপত্তি দেবী সরস্বতীর থেকে হয়েছিল বলে ব্রহ্মা সরস্বতীর নাম দেন বাগদেবী।
- ঋকবেদে দেবী হিসেবে সরস্বতীর প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায়।
দেবী সরস্বতীর রুপ বর্ণনা
বাগদেবী সরস্বতীকে বেদ মাতা বলা হয়। বেদ যেহেতু চারটি ঋক, সাম, যজুঃ, এবং অথর্ব। তাই সরস্বতীর চারটি হাতকে চার বেদের প্রতীক বলে ধরে নেয়া হয়। তাঁর চার হাতে – বই, জপমালা, বীণা এবং জলপাত্র। কোথাও বা জলপাত্র থাকে না বীণাটি দুহাতে ধরা থাকে। বই হল- ‘গদ্যের প্রতীক’, মালা ‘কবিতার প্রতীক’, বীণা ‘সংগীতের প্রতীক’ আর জলপাত্র ‘পবিত্র চিন্তার প্রতীক’।
দেবী সরস্বতীকে ‘বেদ মাতা’ বলা হয় কেন?
- পুস্তক অনুসারে ভগবান ব্রহ্মা সহধর্মিনী সরস্বতী। আদি পিতা ব্রহ্মা, বেদের স্রষ্টা তাই তাঁর সহধর্মিনী মাতা সরস্বতী হলেন বেদ মাতা।
- মাতা সরস্বতী ছিলেন সমস্ত জ্ঞানের অধিকারিনী, শিক্ষা প্রদানকারী তাঁর আশীর্বাদ ব্যতীত কারো জীবনের অজ্ঞতা নামক অন্ধকার দূর হয় না। ‘বেদ’ থেকে জ্ঞান আহরণের জন্য মাতা সরস্বতীর আশীর্বাদ ধন্য হওয়া প্রয়োজন, তাই তাকে ‘বেদ মাতা’ বলা হয়।
দেবী ‘শুক্লাবর্ণা’ কেন?
- পবিত্র গীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের শ্লোক- ‘তত্র সত্ত্বাং নির্মলাত্বাৎ’ অর্থাৎ সত্ব, তমো ও রাজগুনের মধ্যে সত্ব গুন অতি পবিত্র গুন।
- চতুর্দশ অধ্যায় ১৭ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে- ‘সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানং’ অর্থাৎ সত্ত্ব গুণে জ্ঞান লাভ হয়।
- শুক্ল মানে সাদা, শুক্লবর্ণ বা সাদা বর্ণ হলো ভালো গুণের প্রতীক। তাই জ্ঞানময়ী সর্বগুণের আধিকারিণী দেবী শ্রী শ্রী সরস্বতীর গায়ে রং শুক্লা বর্ণ অর্থাৎ দোষহীন। পবিত্র চিন্তা আর জ্ঞান দান করেন বলে তিনি জ্ঞানদায়িনী ।
দেবী সরস্বতীর হাতে ‘পুস্তক’ কেন?
দেবী শ্রীশ্রী সরস্বতী জ্ঞান প্রদায়নকারী আর বিদ্যার্থীদের লক্ষ্য জ্ঞান অন্বেষণ । জ্ঞানের ভান্ডার ‘বেদ’, সেই বেদই বিদ্যা। মাতা সরস্বতীর হাতে আছে বেদ। আর জ্ঞান ও বিদ্যা আহরণের জন্য বিদ্যার্থীদের মাতা সরস্বতীর আশীর্বাদ ধন্য হওয়া প্রয়োজন। মাতা সরস্বতী আমাদের সর্বসময় আশীর্বাদ করছেন আমাদের জীবনকে শুভ্র ও পবিত্র করতে।
দেবী ‘বীণাপাণি’ কেন?
বীণার সুর অত্যন্ত মধুর, বীণার জীবন ছন্দময়, বীনার ঝংকারে উঠে আসে ধ্বনি বা নাদ মাতা সরস্বতীর আশীর্বাদ ধন্য হলে ভক্তরা তবে বীণার ধ্বনি শুনতে পায়। বীণার সুর যেমন মধুর তেমনি বিদ্যার্থীর মুখ নিঃসৃত বাক্য যেন মধুর ও সংগীতময় হয় সেই কারণে মায়ের হাতে বীণা। তাই তাই দেবী সরস্বতীর আরেক নাম ‘বীণাপাণি’।
দেবী ‘হংসবাহনা’ কেন?
জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহংস। অবিদ্যা থেকে বিদ্যা কে ছেঁকে নেওয়াই আসল শিক্ষা। হাঁস দুধ ও জলের মিশ্রণ থেকে জল ফেলে শুধু দুধটুকু গ্রহণ করে। আবার কাদা মিশ্রিত স্থান থেকে তার খাদ্য খুঁজে নিতে পারে। দেবী সরস্বতী হংস বাহিনী রাজহংস মায়ের সঙ্গে পূজিত হয়ে এই শিক্ষা দিচ্ছে সবাই যেন অসাড়, ভেজাল, অকল্যাণ কে পরিহার করে নিত্য পরমাত্মাকে গ্রহণ করে এবং পরমার্থিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে।