রাখি কি এবং কবে পালিত হয়?
হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমায় পালিত হয় রাখি বন্ধন। এই উৎসব ভাই-বোনের স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করে, এই দিনে বোন তার ভাইকে কপালে টিকা লাগিয়ে রক্ষার বন্ধন রাখি হাতে বেঁধে দেয় যাকে আমরা “রাখীবন্ধন উৎসব” বলি ।
রাখীবন্ধন উৎসব বা রাখীপূর্ণিমা দক্ষিণ এশিয়ার একটি উৎসব। হিন্দু ,মুসলিম , জৈন, বৌদ্ধ ও শিখরা এই উৎসব পালন করে। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব উদযাপিত হয়।
কিভাবে পালিত হয় এই রাখীবন্ধন উৎসব?
রাখীবন্ধন উৎসবের দিন দিদি বা বোনেরা তাদের ভাই বা দাদার হাতের কবজিতে রাখী নামে একটি পবিত্র সুতো বেঁধে দেয়। পরিবর্তে ভাই বোনকে উপহার দেয় এবং সারাজীবন তাকে রক্ষা করার শপথ নেয়। এরপর ভাই-বোন পরস্পরকে মিষ্টি খাওয়ায়। উত্তর ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে সহোদর ভাইবোন ছাড়াও জ্ঞাতি ভাইবোন এবং অন্যান্য আত্মীয়দের মধ্যেও রাখীবন্ধন উৎসব প্রচলিত। অনাত্মীয় ছেলেকেও ভাই বা দাদা মনে করে রাখী পরানোর রেওয়াজ রয়েছে।
পৌরাণিকালে রাখীবন্ধন:
কৃষ্ণ ও দ্রৌপদী- মহাভারতে বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী একটি যুদ্ধে কৃষ্ণের কব্জিতে আঘাত লেগে রক্তপাত শুরু হলে পাণ্ডবের স্ত্রী দ্রৌপদী শাড়ির আঁচল খানিকটা ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দেন। এতে কৃষ্ণ অভিভূত হয়ে তাকে নিজের বোন হিসেবে ঘোষণা করেন এবং পরে দ্রৌপদী যখন বিপদে পড়েন তার সম্মান রক্ষার্থে কৃষ্ণ তার প্রতিদান দেন এইভাবে রাখিবন্ধনের প্রচলন হয় ।
বলিরাজা ও লক্ষ্মী- পৌরাণিক তথ্য অনুযায়ী দৈত্য রাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। বিষ্ণু যখন বৈকুণ্ঠ ছেড়ে বালির রাজ্য রক্ষা করতে এসেছিলেন, বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষী দেবী স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য একটি সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলি রাজ্যে চলে আসেন এবং স্বামীর নিরুদ্দেশের কথা জানান, ছদ্দবেশী লক্ষ্মীকে আশ্রয় দেন বলি রাজা। এরপর লক্ষী দেবী জানান যে যতদিন না তার স্বামী ফিরে পান ততদিন তিনি এখানে থাকবেন । এরপর লক্ষী দেবী শ্রাবণ পূর্ণিমা উপলক্ষে একটি রাখি বেঁধে দেন বলিরাজার হাতে । বলি রাজা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষী দেবী আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন । এতে বলিরাজা মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন। সেই থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি বোনেরা রাখীবন্ধন হিসেবে পালন করে।
ঐতিহাসিক কালে রাখীবন্ধন
মহামতি আলেকজান্ডার ও পুরু রাজা- ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করার জন্য। পুরু ছিলেন কাটোচ রাজা। তিনি রাখীকে সম্মান করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নিজে আলেকজান্ডারকে আঘাত করেননি।
এছাড়াও রানি কর্ণবতী ও সম্রাট হুমায়ুন একটি রাখীবন্ধনের ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাখী বন্ধন- ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখী বন্ধন উৎসব পালন করেছিলেন। তিনি কলকাতা, ঢাকা ও সিলেট থেকে হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম ভাই ও বোনকে আহ্বান করেছিলেন একতার প্রতীক হিসাবে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য।
শ্রাবণ মাসে হিন্দু ভাইবোনদের মধ্যে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বোধ জাগিয়ে তোলা এবং ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে রাখী বন্ধন উৎসব পালন করার জন্য আহ্বান করেন। রবীন্দ্রনাথ এই দিনটির উদ্দেশে একটি গান লিখেছিলেন।
“বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ-
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান।
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা –
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান।
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন –
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।”