নাম (Name) | শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Sarat Chandra Chattopadhyay) |
জন্ম (Birthday) | বাংলা ১২৮৩ বঙ্গাব্দের ৩১শে ভাদ্র ও ইংরেজী ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ই সেপ্টেম্বর |
জন্মস্থান (Birthplace) | হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে |
অভিভাবক (Guardian) / পিতামাতা | তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী |
পেশা (Occupation) | ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার |
জাতীয়তা (Nationality) | ভারতীয় (Indian) |
দাম্পত্য সঙ্গী (Spouse) | শান্তি দেবী এবং হিরণ্ময়ী দেবী |
উল্লেযোগ্য রচনাবলী | বৈকুন্ঠের উইল (গল্প), পরিণীতা (গল্প) |
উল্লেযোগ্য উপন্যাস | দেবদাস (উপন্যাস), শ্রীকান্ত (উপন্যাস), গৃহদাহ (উপন্যাস) |
মৃত্যু (Death) | রবিবার ১৬ জানুয়ারি (বাংলা ১৩৪৪ সালের ২ মাঘ), সকাল ১০টা ১০ মিনিটে শরৎচন্দ্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। |
ভারতীয় সাহিত্যে কথাশিল্পী বলতে একজনকেই আমরা জানি তিনি হলেন অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্র নিপুন চিত্রকরের মত সমাজের নিপীড়িত, বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের দুঃখ-বেদনা, অভাব- অভিযোগ, আর সমাজপতি বিত্তবানদের অনাচার, অন্যায় ভন্ডামি গুলো চিত্রিত করেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসের মধ্যে। তৎকালীন নারী সমাজের সামগ্রিক রূপ অর্থাৎ নারী জাতির সরলতা, মায়া- মমতা, স্নেহ, ব্যথা- বেদনা তাদের প্রতি পুরুষের অবিচার তিনি গভীর সহানুভূতির সাথে ব্যক্ত করেছেন তাঁর রচনায়। শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল বাংলা ১২৮৩ বঙ্গাব্দের ৩১শে ভাদ্র ও ইংরেজী ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ই সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র নামে শরৎচন্দ্রের আরও দুই ছোটভাই এবং অনিলা দেবী ও সুশীলা দেবী নামে দুই বোনও ছিলেন।
ছেলেবেলা ও শিক্ষাজীবন-
শরৎচন্দ্রের পিতা ছিলেন মতিলাল চট্টোপাধ্যায়, তিনি খুব উদাসী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। পাণ্ডিত্যের জন্য প্রচুর খ্যাতি ছিল তাঁর বহু গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক রচনা করলেও কোনোটি তিনি শেষ এবং প্রকাশ করে যেতে পারেননি। এই উদাসী মনোভাবের জন্য মতিলালের সংসারে দারিদ্র ছিল নিত্য সঙ্গী, তাই শরৎচন্দ্রের ছোটবেলা কেটেছে প্রচন্ড অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে। মামার বাড়িতে অর্থাৎ ভাগলপুরে তাকে থাকতে হয়েছিল। ছোটবেলায় সব চুল উঠে গিয়েছিল তাই সেই সময় থেকে সবাই তাকে ন্যাড়া নামে ডাকতো।
পাঁচ ভাই ও বোনেদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম ছেলে তাই মা ঠাকুমার অতিরিক্ত স্নেহ আর আদরে ন্যাড়া হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত জেদি আর দুরন্ত। দেবানন্দপুর- এর প্রতিটি ঘরে ঘরে ন্যাড়া আর তার দলবল ছিল বিভীষিকার মত। পড়াশুনাতে বেশি মন ছিল না তার, প্রতিদিন দুষ্টুমি আর খেলাধুলাতেই ছিল তার মন। কিন্তু পন্ডিত বাবার ছেলে তো অশিক্ষিত হয়ে থাকতে পারে না তাই তাকে ভর্তি করা হলো গ্রামের পিয়ারী পন্ডিতের পাঠশালাতে। কিন্তু ন্যাড়ার দুষ্টুমি বুদ্ধি মাঝেমধ্যেই স্কুলে ফাঁকি মেরে গ্রামের ছেলেদের নিয়ে ঘুরে বেড়াত পথে ঘাটে, জঙ্গলে সরস্বতী নদীর তীরে।
মাছ ধরবার ভালো ছিপ ছিল না তার কিন্তু ছিল মাছ ধরবার ভীষণ শখ ঠাকুমার কাছে বায়না করে ছিপ কিনতে চলল গ্রামের দুরন্ত লাঠিয়াল নয়ন চাঁদ দের সাথে বসন্তপুর হাটে। আদুরে নাতির বায়না ঠাকুরমা মিটিয়ে ছিলেন সেইবার। হাট থেকে যখন নয়নচাঁদ গরু আর ন্যাড়া ছিপ কিনে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিল পথে তাঁরা পরল ঠ্যাঙ্গাড়েদের পাল্লায়, প্রাণটাই চলে যেত শুধু নয়নচাঁদের লাঠির জেরে প্রাণ নিয়ে বাড়ি যেতে পেরেছিল সে যাত্রায়। এরপর নতুন ছিপে পুকুর ও নদীতে মাছ ধরে বেড়াতে লাগলো।
শরৎচন্দ্র দেবানন্দপুর থেকে ভাগলপুরে আসার পর তাঁর মাতামহ তাঁকে ভাগলপুরের দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ের ছাত্রবৃত্তি বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেন। সেই ক্লাসে শরৎচন্দ্রের মাতামহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অঘোরনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র মণীন্দ্রনাথও পড়তেন। সেই বছর ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় শরৎচন্দ্র এবং মণীন্দ্রনাথ দুজনেই সফলভাবে উত্তীর্ণ হন।
ছাত্রবৃত্তি পাস করে শরৎচন্দ্র ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ভাগলপুরের জেলা স্কুলে সেভেন্থ্ ক্লাসে, যা বর্তমানে চতুর্থ শ্রেণী হিসেবে পরিচিত, ভর্তি হন। ছাত্রবৃত্তির পাঠ্যক্রমে তখন ইংরেজি পড়ানো হত না, তবে বাংলা, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হতো। শরৎচন্দ্র ছাত্রবৃত্তি পাস করায় জেলা স্কুলের সেভেন্থ্ ক্লাসের বাংলা ও অঙ্ক তাঁর কাছে খুব সহজ মনে হয়েছিল, তাই তাঁকে কেবল ইংরেজিতেই বেশি মনোযোগ দিতে হয়েছিল।
ফলস্বরূপ, সে বছরের শেষে পরীক্ষায় শরৎচন্দ্র ইংরেজি এবং অন্যান্য বিষয়েও এত ভালো ফল করেছিলেন যে, শিক্ষকেরা তাঁকে ডবল প্রমোশন দেন। ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেভেন্থ্ ক্লাস থেকে সরাসরি ফিফ্থ্ ক্লাসে উন্নীত হন, সিক্স্থ্ ক্লাস অতিক্রম করে। তখনকার দিনে নাইন্থ্ ক্লাস থেকে ফার্স্ট ক্লাস পর্যন্ত এইভাবে শ্রেণীবিন্যাস করা হত, যেখানে ফার্স্ট ক্লাস ছিল বর্তমানের দশম শ্রেণীর সমান।
১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র জেলা স্কুলের ফোরথ্ ক্লাসে ওঠেন, কিন্তু সেই সময় তাঁর পিতার ডিহিরির চাকরিটি চলে যায়। পিতা তখন পুরো পরিবার নিয়ে আবার দেবানন্দপুরে ফিরে আসেন। শরৎচন্দ্রও বাবা-মায়ের সঙ্গে দেবানন্দপুরে ফিরে যান এবং ওই বছর, অর্থাৎ ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের ফোরথ্ ক্লাসে ভর্তি হন।
১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে, যখন শরৎচন্দ্র ফার্স্ট ক্লাসে পড়ছিলেন, তখন তাঁর পিতা অভাবের কারণে স্কুলের মাসিক ফি দিতে পারেননি। এর ফলে শরৎচন্দ্রকে স্কুল ছেড়ে দিতে হয় এবং তিনি ঘরে বসে থাকেন। এই সময়ে, ১৭ বছর বয়সে, শরৎচন্দ্র তাঁর প্রথম গল্প ‘কাশীনাথ’ লেখেন, যা তাঁর পাঠশালার সহপাঠী কাশীনাথের নামানুসারে লেখা। তিনি আরও একটি গল্প ‘ব্রহ্মদৈত্য’ লেখেন, তবে সেই গল্পটি এখন আর পাওয়া যায় না।
দেবানন্দপুরে মতিলালের আর্থিক সংকট ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠায়, তিনি বাধ্য হয়ে সপরিবারে আবার ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যান। এটি ছিল ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকের ঘটনা। ভাগলপুরে ফিরে আসার পর শরৎচন্দ্র আবার স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু সমস্যাটি ছিল হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের বকেয়া মাসিক ফি পরিশোধ করে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট আনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে।
১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে শরৎচন্দ্রের মাতামহের মৃত্যুতে মামাদের একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যায়। বড় মামা ঠাকুর দাস তখন চাকরিহীন ছিলেন, আর ছোট মামা বিপ্রদাস অল্প বেতনে নতুন চাকরি শুরু করেছিলেন। বিপ্রদাসকেই তাঁর নিজের এবং শরৎচন্দ্রের বাবার পরিবার চালাতে হতো।
এই সময়ে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ভাগলপুরের তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন এবং শরৎচন্দ্রের মামাদের প্রতিবেশী ছিলেন, শরৎচন্দ্রের পড়ার আগ্রহ দেখে তাঁকে তাঁদের স্কুলে ভর্তি করান। শরৎচন্দ্র এই স্কুল থেকেই ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন এবং দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরীক্ষার আগে, স্কুলের পরীক্ষার ফি ও বকেয়া মাসিক ফি জমা দেওয়ার জন্য শরৎচন্দ্রের ছোট মামা বিপ্রদাসকে মহাজন গুলজারীলালের কাছে হ্যান্ডনোট লিখে টাকা ধার করতে হয়েছিল।
শরৎচন্দ্রের মাতামহের কনিষ্ঠ ভ্রাতা অঘোরনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র মনীন্দ্রনাথও সেই একই বছরে এন্ট্রান্স পাস করেন। মনীন্দ্রনাথ তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হলেও, শরৎচন্দ্র টাকার অভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। বিপ্রদাসের অর্থনৈতিক অক্ষমতা শরৎচন্দ্রকে কলেজে ভর্তি করাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
শরৎচন্দ্রের শিক্ষার এমন অনিশ্চয়তা দেখে মনীন্দ্রনাথের মা কুসুমকামিনী দেবীর মন নরম হয়ে আসে। স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করে, তিনি শরৎচন্দ্রকে তাঁদের দুই ছোট ছেলে সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে পড়ানোর বিনিময়ে কলেজে ভর্তি ও মাসিক খরচ চালানোর ব্যবস্থা করে দেন। এর ফলে শরৎচন্দ্র কলেজে ভর্তি হতে সক্ষম হন। রাতে তিনি সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে পড়াতেন, যারা তখন স্কুলের নিম্ন ক্লাসে পড়ত। বাড়ির অন্য ছোট ছেলেরাও তাঁর কাছ থেকে পড়াশোনা করত।
কলেজে পড়ার সময় শরৎচন্দ্র টাকার অভাবে পাঠ্যপুস্তক কিনতে পারেননি। তাই, তিনি মনীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য সহপাঠীদের কাছ থেকে বই ধার নিয়ে রাতে জেগে পড়াশোনা করতেন এবং সকালে সেই বই ফেরত দিতেন। এভাবে দু’বছর কলেজে পড়ার পরও, টেস্ট পরীক্ষার শেষে এফ.এ. পরীক্ষার ফি হিসেবে মাত্র ২০ টাকা জোগাড় করতে না পারায়, শরৎচন্দ্র আর এফ.এ. পরীক্ষা দিতে পারেননি।
এই সময়ে শরৎচন্দ্র মামার বাড়িতে ছিলেন না, কারণ ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে তাঁর মায়ের মৃত্যু ঘটে। এর কিছুদিন পর তাঁর পিতা মতিলাল শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে পুত্রকন্যাদের নিয়ে ভাগলপুরের খঞ্জরপুর পল্লীতে চলে আসেন। সেখানে তারা একটি মাটির ঘরে বাস করতে শুরু করেন। মতিলালের জ্যেষ্ঠ কন্যা অনিলা দেবীর বিয়ে ইতিপূর্বে হাওড়া জেলার বাগনান থানার গোবিন্দপুর গ্রামে হয়েছিল এবং তিনি শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন।
বৈবাহিক জীবন-
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রেঙ্গুনে থাকার সময়কার জীবন এবং তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঘটনাগুলি অত্যন্ত মানবিক ও সংবেদনশীল। তিনি রেঙ্গুনে থাকা অবস্থায় শহরের উপকণ্ঠের বোটাটং-পোজনডং অঞ্চলে মিস্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা সমস্যায় সহায়তা করতেন। তাঁর উদার মানসিকতা ও মানবিক কার্যকলাপের জন্যই মিস্ত্রীরা তাঁকে “দাদাঠাকুর” বলে সম্বোধন করত।
শরৎচন্দ্রের জীবনে শান্তি দেবী এবং হিরণ্ময়ী দেবীর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম স্ত্রী শান্তি দেবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একটি সহানুভূতিপূর্ণ ঘটনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, যেখানে শান্তি দেবী একজন মাতালের সঙ্গে বিবাহে বাধ্য হচ্ছিলেন, কিন্তু শরৎচন্দ্র তাঁকে সেই বিপদ থেকে রক্ষা করে নিজেই বিবাহ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, শান্তি দেবী এবং তাঁদের একমাত্র পুত্র প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, যা শরৎচন্দ্রকে গভীর শোকাহত করে তোলে।
এর পরে, শরৎচন্দ্রের জীবনে হিরণ্ময়ী দেবীর আগমন ঘটে। হিরণ্ময়ী দেবীর বাবা কৃষ্ণদাস অধিকারী শরৎচন্দ্রের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং শরৎচন্দ্রের প্রতি আস্থা রেখে তাঁর কন্যার বিবাহের প্রস্তাব দেন। যদিও প্রথমে শরৎচন্দ্র কিছুটা অস্বস্তিতে ছিলেন, শেষ পর্যন্ত তিনি হিরণ্ময়ী দেবীকে বিয়ে করেন। এই বিবাহের পর শরৎচন্দ্র তাঁর স্ত্রীর নাম মোক্ষদা থেকে পরিবর্তন করে হিরণ্ময়ী রাখেন।
হিরণ্ময়ী দেবী ছিলেন শান্ত, সেবাপরায়ণ এবং ধর্মশীলা, এবং শরৎচন্দ্র তাঁকে লেখাপড়া শিখিয়ে তাঁর জীবনে শিক্ষার আলো এনে দেন। তাঁদের এই সম্পর্ক শরৎচন্দ্রের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুখ ও শান্তির মধ্য দিয়ে কেটেছে।
এই জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি শরৎচন্দ্রের রচনায় গভীর মানবিক অনুভূতি ও সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রামের প্রতিফলন ঘটিয়েছে, যা তাঁর সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান তৈরি করেছে।
ঊল্লেখ যোগ্য রচনা ও সাহিত্যচর্চা-
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত গ্রন্থগুলির প্রকাশকাল অনুযায়ী একটি তালিকা নিচে দেওয়া হল। এটি তাঁর উপন্যাস, গল্প, এবং প্রবন্ধের প্রকাশকালীন ক্রম হিসেবে সাজানো। শরৎচন্দ্রের কিছু অসমাপ্ত ও টুকরো লেখাও রয়েছে, তবে এখানে তাঁর প্রধান রচনাগুলির তালিকা তুলে ধরা হয়েছে:
১৯১৩
- সেপ্টেম্বর: বড়দিদি (উপন্যাস)
১৯১৪
- মে: বিরাজ বৌ (উপন্যাস)
- জুলাই: বিন্দুর ছেলে (গল্প-সমষ্টি)
- আগস্ট: পরিণীতা (গল্প)
- সেপ্টেম্বর: পণ্ডিতমশাই (উপন্যাস)
১৯১৫
- ডিসেম্বর: মেজদিদি (গল্প-সমষ্টি)
১৯১৬
- জানুয়ারী: পল্লী-সমাজ (উপন্যাস)
- মার্চ: চন্দ্রনাথ (উপন্যাস)
- আগস্ট: বৈকুন্ঠের উইল (গল্প)
- নভেম্বর: অরক্ষণীয়া (গল্প)
১৯১৭
- ফেব্রুয়ারি: শ্রীকান্ত (১ম পর্ব, উপন্যাস)
- জুন: দেবদাস (উপন্যাস)
- জুলাই: নিষ্কৃতি (গল্প)
- সেপ্টেম্বর: কাশীনাথ (গল্প-সমষ্টি)
- নভেম্বর: চরিত্রহীন (উপন্যাস)
১৯১৮
- ফেব্রুয়ারি: স্বামী (গল্প-সমষ্টি)
- সেপ্টেম্বর: দত্তা (উপন্যাস)
- সেপ্টেম্বর: শ্রীকান্ত (২য় পর্ব, উপন্যাস)
১৯২০
- জানুয়ারী: ছবি (গল্প-সমষ্টি)
- মার্চ: গৃহদাহ (উপন্যাস)
- অক্টোবর: বামুনের মেয়ে (উপন্যাস)
১৯২৩
- এপ্রিল: নারীর মূল্য (প্রবন্ধ)
- আগস্ট: দেনা-পাওনা (উপন্যাস)
১৯২৪
- অক্টোবর: নব-বিধান (উপন্যাস)
১৯২৬
- মার্চ: হরিলক্ষ্মী (গল্প-সমষ্টি)
- আগস্ট: পথের দাবী (উপন্যাস)
১৯২৭
- এপ্রিল: শ্রীকান্ত (৩য় পর্ব, উপন্যাস)
- আগস্ট: ষোড়শী (উপন্যাসের নাট্যরূপ, ‘দেনা-পাওনা’)
১৯২৮
- আগস্ট: রমা (নাট্যরূপ, ‘পল্লী-সমাজ’)
১৯২৯
- এপ্রিল: তরুণের বিদ্রোহ (প্রবন্ধ-সংগ্রহ)
১৯৩১
- মে: শেষ প্রশ্ন (উপন্যাস)
১৯৩২
- আগস্ট: স্বদেশ ও সাহিত্য (প্রবন্ধ-সংগ্রহ)
১৯৩৩
- মার্চ: শ্রীকান্ত (৪র্থ পর্ব, উপন্যাস)
১৯৩৪
- মার্চ: অনুরাধা, সতী ও পরেশ (গল্প-সমষ্টি)
- ডিসেম্বর: বিজয়া (নাট্যরূপ, ‘দত্তা’)
১৯৩৫
- ফেব্রুয়ারী: বিপ্রদাস (উপন্যাস)
[মৃত্যুর পরে প্রকাশিত]
১৯৩৮
- এপ্রিল: ছেলেবেলার গল্প (তরুণপাঠ্য গল্প-সমষ্টি)
- জুন: শুভদা (উপন্যাস)
পরলোক গমন-
শরৎচন্দ্রের জীবনের শেষ ক’বছর শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। তিনি প্রায়ই বিভিন্ন রোগে ভুগতেন। ১৯৩৭ সালের গোড়ার দিকে তিনি কিছুদিন জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। জ্বর সেরে যাওয়ার পর ডাক্তারের পরামর্শে তিনি দেওঘরে বেড়াতে যান এবং সেখানে তিন-চার মাস অবস্থান করেন। দেওঘর থেকে ফিরে আসার পর কিছুদিন সুস্থ থাকলেও সেপ্টেম্বর মাসে শরৎচন্দ্র আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবার তাঁর পাকাশয়ে সমস্যা দেখা দেয়, যা দ্রুত বাড়তে থাকে। তাঁর খাবার ঠিকমতো হজম হতো না এবং পেটের ব্যথাও বেড়ে যায়।
এই সময়ে শরৎচন্দ্র সামতাবেড় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। চিকিৎসার জন্য তিনি কলকাতায় আসেন। সেখানে ডাক্তাররা এক্স-রে করে দেখতে পান, তাঁর যকৃত ক্যানসারে আক্রান্ত এবং এই রোগ তাঁর পাকস্থলীতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
শরৎচন্দ্র এই সময় একটি উইল করেন, যেখানে তিনি তাঁর যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবীকে জীবনকালীন দান করেন। উইলে আরও উল্লেখ করেন, হিরণ্ময়ী দেবীর মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রকাশচন্দ্রের পুত্র বা পুত্ররা সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হবেন। (হিরণ্ময়ী দেবী তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর প্রায় ২৩ বছর বেঁচে ছিলেন এবং ১৩৬৭ সালের ১৫ই ভাদ্রে তাঁর মৃত্যু হয়।)
কলকাতার তৎকালীন বিশিষ্ট চিকিৎসকরা—ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এবং ডাঃ কুমুদশঙ্কর রায়—শরৎচন্দ্রকে পরীক্ষা করে জানান, তাঁর পেটে অস্ত্রোপচার ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ডাঃ ম্যাকের সুপারিশে শরৎচন্দ্রকে দক্ষিণ কলকাতার ৫নং সুবার্বন হসপিটাল রোডে একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে নেওয়া হয়। তবে সেখানে সিগারেট খেতে না দেওয়ার কারণে শরৎচন্দ্র কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেন। এছাড়া ইউরোপীয় নার্সরা স্থানীয় রোগীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন না, যা শরৎচন্দ্রের অসন্তুষ্টির কারণ হয়। এ কারণে তিনি দুদিন পর সেখান থেকে সরে এসে তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয় ডাঃ সুশীল চ্যাটার্জীর পার্ক নার্সিং হোমে ভর্তি হন।
শরৎচন্দ্রের অসুস্থতার খবর শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক পত্রে লেখেন:
“কল্যাণীয়েষু,
শরৎ, রুগ্ন দেহ নিয়ে তোমাকে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে হয়েছে শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলুম। তোমার আরোগ্য লাভের প্রত্যাশায় বাংলা দেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকবে। ইতি ৩১।১২।৩৭”
এই সময়ের বিখ্যাত সার্জন ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের পেটে অস্ত্রোপচার করেন। তবে অপারেশন করেও শরৎচন্দ্রকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ১৯৩৮ সালের ১২ জানুয়ারি অপারেশন হয় এবং এর চারদিন পর, রবিবার ১৬ জানুয়ারি (বাংলা ১৩৪৪ সালের ২ মাঘ), সকাল ১০টা ১০ মিনিটে শরৎচন্দ্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬১ বছর ৪ মাস।
শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর খবর শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে ইউনাইটেড প্রেসের প্রতিনিধিকে বলেন, “যিনি বাঙালির জীবনের আনন্দ ও বেদনাকে একান্ত সহানুভূতির দ্বারা চিত্রিত করেছেন, আধুনিক কালের সেই প্রিয়তম লেখকের মহাপ্রয়াণে দেশবাসীর সঙ্গে আমিও গভীর মর্মবেদনা অনুভব করছি।”
কয়েকদিন পরে, ১২ই মাঘ, রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের মৃত্যু উপলক্ষে একটি কবিতা লিখেছিলেন:
“যাহার অমর স্থান প্রেমের আসনে।
ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে।
দেশের মাটির থেকে নিল যারে হরি
দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে বরি।”