দীপাবলি নামের অর্থ কি?
দীপাবলি হল হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলির মধ্যে একটি। দীপাবলি-র অর্থ প্রদীপের সমষ্টি। দূর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা কাটিয়ে বাঙালি যে উৎসবে মেতে ওঠে তা দীপাবলি বা কালীপূজা। ভারতীয় ও অন্যান্য ধর্মালম্বীরাও এটি উদযাপন করে থাকে। উত্তর ভারতে এই সময় দেওয়ালি উৎসব উদযাপন হয়, দক্ষিণ ভারতে তথা বাংলায় কালীপূজা বা দীপাবলি উৎসব হয়।
উত্তর ভারতের পাঁচ দিন ব্যাপী দেওয়ালি উৎসব পালিত হয়। বাংলায় এই উৎসব একটু পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়ে পালিত হয় যা দীপাবলি বা কালীপূজা নামে পরিচিত। এই পাঁচ দিন হল যথাক্রমে ধনতেরাস বা ধনত্রয়োদশী, নরক চতুর্দশী বা ভূত চতুর্দশী, কার্তিক অমাবস্যীয় কালীপূজা বা দীপাবলি, লক্ষী- গণেশ পূজা, এবং গোবর্ধন পূজা বা অন্নকুট।
ধনতেরাস বা ধনত্রয়োদশী–
কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে উত্তর ভারতে ধনতেরাস বা ধনত্রয়োদশী উৎসব পালিত হয়। এই তিথিতে লক্ষ্মী, কুবের, যমের পুজো করা হয়। মনে করা হয় এই দিনই হয়েছিল সমুদ্রমন্থন। সমুদ্রমন্থনের সময় যাবতীয় দৈব সামগ্রী এবং অমৃতের সঙ্গে উঠে এসেছিলেন মা লক্ষ্মী, তাই এই দিন ধনসম্পত্তির জন্য হিন্দুরা লক্ষী দেবীর পূজাও করে থাকে। একইভাবে কুবেরের কাছেও থেকে দেবতাদের সম্পদ, তাই ধন-সম্পদের জন্য ওই দিন কুবেরেরও পূজা প্রচলিত। মনে করা হয় এই দিন কোন ধাতু দ্রব্য কিনলে তার মূল্য বৃদ্ধিপায়। ধনতেরাসের দিন যমরাজের আরাধনাও করা হয়। বর্তমানে দক্ষিণ ভারত তথা বাংলায় ধনতেরাসের দিন ধাতব দ্রব্য কেনার উচ্ছ্বাস দেখা যায়।
নরক চতুর্দশী বা ভূত চতুর্দশী–
কার্তিক মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশীর দিন পালিত হয় ভূত চতুর্দশী। এই দিন বাড়িতে আকাশ প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করা হয়, বাড়িতে প্রদীপ ও বাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। মনে করা হয় এই প্রদীপের আলোয় পূর্বপুরুষদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে, তারা এসে বর্তমান প্রজন্মকে আশীর্বাদ দেন। এছাড়াও সেদিন চোদ্দ ভুবনের অধীশ্বরি দেবীর উদ্দেশ্যে ১৪ দীপ দান করা হয় এবং চৌদ্দ শাক খাওয়ার রীতি আছে। এই চোদ্দ শাক হল– ১) ওল, ২) কেঁউ, ৩) বেতো, ৪) সর্ষে, ৫) কালকাসুন্দে, ৬) নিম, ৭) জয়ন্তী, ৮) শাঞ্চে, ৯) হেলেঞ্চা, ১০) পলতা, ১১) শুলফা, ১২) গুলঞ্চ, ১৩) ভাঁট পাতা, ১৪) শুষনি শাক।
কালীপূজা বা দীপাবলি–
প্রধানত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এই উৎসব উপলক্ষে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষিত হয়।কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যা তিথিতে মা কালীর আরাধনা করা হয়। এই দিন আলোকসজ্জা, মণ্ডপসজ্জা ও আতসবাজির উৎসবের মধ্য দিয়ে সারা রাত্রিব্যাপী মণ্ডপে, বাড়িতে এবং মন্দিরগুলিতে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। দিনগুলোতে অফিস, মন্দির, দোকানপাট, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি সবকিছু আলোয়- আলোয় ভরিয়ে তোলা হয়। দীপাবলি পালনের সময় দিয়া বা মাটির তৈরি প্রদীপ জ্বালানো হয়। বাঙালিরা আনন্দে মেতে ওঠে আতশবাজি ফাটান, রকমারি ফানুস আকাশে ওড়ান, মন্ডপে মন্ডপে ঠাকুর দেখতে যান। উত্তর ভারতে অনেক বাড়িতে আবির দিয়ে সুন্দর আলপনা বানানো হয়, যাকে রঙ্গোলি বলে। রঙ্গোলি তৈরীর উদ্দেশ্য কেবল সজ্জা নয়, প্রতিটি বাড়ির ভেতরে দেবি লক্ষ্মী অন্যান্য অতিথিদের স্বাগত জানানো ও বটে।
লক্ষী- গণেশ পূজা–
উত্তর ভারতে দীপাবলীর দিন অথবা তার ঠিক পরের দিন সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য ঘরে ঘরে লক্ষ্মী ও গণেশের পূজা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে দীপাবলির দিন অনেক বাড়িতে অলক্ষী তাড়িয়ে মা লক্ষ্মীকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেই উপলক্ষে লক্ষ্মী পূজা পালন করা হয়। এই পূজা বা উৎসব হল অনিষ্টের ওপর ভালোর জয়, অন্ধকারের ওপরে আলোকপাত, এবং অভিজ্ঞতার ওপরে জ্ঞান লাভ করা।
গোবর্ধন পূজা বা অন্নকুট–
কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে বৃন্দাবনে এই পূজা হয়ে থাকে। বৃন্দাবনবাসী দীপাবলীর পরের দিন গোবর্ধন পর্বতকে পূজা করেন। ভাগবত পুরাণ অনুসারে দেবরাজ ইন্দ্র ক্রোধান্বিত হয়ে বৃন্দাবনের ওপর অবিরাম বর্ষণ শুরু করেন, সে সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকল বৃন্দাবনবাসীকে বাঁচাতে এবং দেবরাজ ইন্দ্রকে যোগ্য জবাব দিতে সেই মহাপ্রলয়ের রাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হাতে করে আঙুল দিয়ে তুলে নিয়েছিলেন গোবর্ধন পর্বত এবং এই গোবর্ধন পর্বতের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন সমগ্র বৃন্দাবনবাসী। সেই থেকে প্রতিবছর এই দিনে শ্রীকৃষ্ণকে এবং গোবর্ধন পর্বতকে পূজা করা হয়। আসলে প্রত্যেক পুজোর মাধ্যমে মানুষ তার জীবনে দুঃখ দুর্দশাকে ভুলে আনন্দ সুস্বাস্থ্য সুখ ভালোবাসার ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়।
দীপাবলি পালিত হওয়ার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কারণ –
১| পৌরাণিক মতে দীপাবলির দিনই রামচন্দ্র সীতাকে নিয়ে চৌদ্দ বছর পর অযোধ্যায় ফিরেছিলেন, সেই আনন্দে অযোধ্যাবাসী তাদের রাজধানী প্রদীপ জ্বেলে সাজিয়ে তোলেন।
২| কার্তিক মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশীর দিন বাড়িতে আকাশ প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করা হয় কারণ প্রচলিত আছে ওইদিন স্বর্গীয় পূর্বপুরুষেরা স্বর্গলোক থেকে বর্তমান প্রজন্মকে আশীর্বাদ প্রদান করতে আসেন।
৩| অলক্ষী তাড়িয়ে মা লক্ষ্মীকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
৪| জৈন মতে ৫২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহাবীর দীপাবলির দিনই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করেছিলেন।
৫| ১৬১৯ খ্রিস্টাব্দে শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ ও ৫২ জন রাজপুত্র দীপাবলীর দিন মুক্তি পেয়েছিলেন বলে শিখরাও এই উৎসব পালন করেন। ৬| আর্য সমাজ এই দিনে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী মৃত্যুদিন পালন করে। তারা এই দিনটি “শারদীয়া নব-শস্যেষ্টি” হিসেবেও পালন করেন। এছাড়া, নেপাল-ভারত-বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই এই উৎসব নিয়ে উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়।