পরিচয়
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পুরো নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি জন্মগ্রহন করেন ১৮২০সালের ২৬ সেপ্টেম্বর (১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন, মঙ্গলবার) বীরসিংহ গ্রামে . পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভগবতী দেবী। পরিবারের আদি নিবাস ছিল অধুনা হুগলি জেলার বনমালীপুর গ্রামে। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত ব্যক্তি। তিনিই ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন। ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় স্বল্প বেতনের চাকরি করতেন। সেই কারণে ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশব বীরসিংহেই তার মা ও ঠাকুরমার সঙ্গে অতিবাহিত হয়।
জন্ম | ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ |
জন্মস্থান | বীরসিংহ গ্রাম, হুগলি জেলা। |
জন্মনাম | ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শর্মা |
পিতা ও মাতা | ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভগবতী দেবী। |
মৃত্যু | ২৯ জুলাই ১৮৯১ (বয়স ৭০)। |
ছদ্মনাম | কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য, কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য। |
পেশা | লেখক, দার্শনিক, পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, প্রকাশক, সংস্কারক, মানবহিতৈষী, অধ্যক্ষ। |
উল্লেখযোগ্য রচনা | বর্ণপরিচয় , কথামালা, আবার অতি অল্প হইল, আবার অতি অল্প হইল, বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা। |
দাম্পত্য সঙ্গী | দীনময়ী দেবী। |
সন্তান | নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। |
শিক্ষাজীবন
বাল্যকাল থেকে ঈশ্বরচন্দ্র অত্যান্ত মেধাবী ছিলেন, তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালা থেকে, পরে তিনি ভর্তি হন কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায় এবং এখান থেকে তিনি সেকালের প্রচলিত বাংলা শিক্ষা লাভ করেছিলেন। পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৮২৮ সালের নভেম্বর মাসে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পদব্রজে পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন এবং পথের ধারে মাইলফলকে ইংরেজি সংখ্যাগুলি দেখে সেগুলি আয়ত্ত করেন। কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের বিখ্যাত সিংহ পরিবারে তারা আশ্রয় নেন। এরপর তিনি নয় বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন মদনমোহন তর্কলঙ্কার। ১৮৩১ সালের মার্চ মাসে বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি এবং একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা উপহার পান।
১৮৩৪ সালে ষষ্ঠশ্রেণির ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র, ক্ষীরপাই নিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দীনময়ী দেবীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। এরপর তিনি স্মৃতি শ্রেণিতে ভর্তি হন সেই যুগে স্মৃতি পড়তে হলে আগে বেদান্ত ও ন্যায়দর্শন পড়তে হত। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের মেধায় সন্তুষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে সরাসরি স্মৃতি শ্রেণিতে ভর্তি নেন। এই পরীক্ষাতেও তিনি অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন এবং হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ত্রিপুরায় জেলা জজ পণ্ডিতের পদ পেয়েও পিতার অনুরোধে তা প্রত্যাখ্যান করে ভর্তি হন বেদান্ত শ্রেণিতে। ১৮৩৮ সালে সমাপ্ত করেন বেদান্ত পাঠ। এই পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং সংস্কৃতে শ্রেষ্ঠ গদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা পুরস্কারও পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। বিদ্যাসাগর ‘ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা’ নামে স্বাক্ষর করতেন৷
বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ
জন্মগ্রহণ কালে তার পিতামহ নাম রাখেন “ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়” ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তার নামের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ব্যবহৃত হয়।
কর্মজীবন ও শিক্ষা-সমাজ সংস্কার-
১৮৪১ সালে মাসিক ৫০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পন্ডিতের ভূমিকায় তার কর্মজীবন শুরু ।
যুগে যুগে সমাজে যখনই দেখা দিয়েছে সামাজিক সংকট তখনই দেখা দিয়েছে ভগবানের এক রূপ। তেমনি ঈশ্বরচন্দ্রের হাত ধরে এসেছে তৎকালীন সমাজের পুরুষ শাষিত নারীর অত্যাচার থেকে মুক্তি। কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে নারীশিক্ষার প্রগতি না করতে পারলে নারী সমাজের অগ্রগতি কখনই সম্ভব না। তাই তিনি ১৮৫৭-১৮৫৮ বর্ষে চারটি জেলায় মোট নারী ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এছাড়া বাংলা তথা মাতৃভাষা শিক্ষার অগ্রগতির জন্য তারই তত্ত্বাবধানে নর্মাল স্কুল স্থাপন করেন। এছাড়াও হার্ডিঞ্জের পরিকল্পনা মতো ১০১টি বঙ্গ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বাংলা ভাষার হাতেখড়ি জন্য তিনি বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড রচনাও করেন।
মাতা ভগবতী দেবীকে শ্রদ্ধা নিবেদন করার উদ্দেশ্য স্বরূপ নারীমুক্তি আন্দোলনকে পাথেয় করে তোলেন। শাস্ত্রীক নিয়মের দোহাই দেওয়া সমাজপতিদের তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে বিধবা নারীরাও মানুষ, তাদেরও সমাজে বাঁচার অধিকার আছে। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং এর সহায়তায় রাজা রামমোহন রায় যে ‘সতীদাহ প্রথা’ রদ করেছিলেন, তারই পন্থা হিসাবে বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮৫৬ সালের ২৬শে জুলাই ‘বিধবা বিবাহ আইন’ পাশও করিয়ে বিধবা নারীদের দেন সমাজে মুক্তির স্বাদ। এমনকি তিনি নিজ খরচে বিধবাদের বিবাহও দিয়েছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি তথাকথিত পুরুষ সমাজের বহু বিবাহ রদ করতে চেয়ে ছিলেন।
সাহিত্য চর্চা
১৮৪৭ সালে বেতাল পঞ্চবিংশতী হিন্দি থেকে বাংলা অনুবাদ করার মাধ্যমে তার সাহিত্যচর্চায় খ্যাতি অর্জন করতে থাকে। এরপর তিনি শকুন্তলা, সীতার বনবাস, মহাভারতের উপক্রমনীকা সংস্কৃত থেকে বাংলায় এবং বাঙ্গালার ইতিহাস, জীবন চরিত, নীতিবোধ, বোধদয়, কথামালা ইংরাজি থেকে বাংলায় রচনা করেন।
শিক্ষামূলক গ্রন্থ হিসাবে ১৮৫৫ সালে বর্ণপরিচয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, ১৮৫১-১৮৫২ তে ঋজুপাঠের ১ম, ২য় ও ৩য় খণ্ড, ১৮৫৩ সালে ব্যাকরণ কৌমদি ও সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা রচনা করেন।
এছাড়াও তার সম্পাদনায় কিছু গ্রন্থ অন্নদামঙ্গল, কুমারসম্ভবম, রঘুবংশম, মেঘদূতম, অভিজ্ঞান শকুন্তলম প্রকাশিত হয়।
এর পাশাপাশি তিনি মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেছিলেন; যেমন সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব, ব্রজবিলাস, প্রভাবতী সম্ভাষণ, রত্নপরীক্ষা, শব্দমঞ্জুরী; সমাজসংস্কার মূলক- ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’, বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিশয়ক প্রস্তাব’ বিষয়ে রচনা করেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
বাঙালি সমাজ তথা সমগ্র ভারতবাসীর কাছে বিদ্যাসাগর মহাশয় আজও এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৩৯ সালের ২২ শে এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার ফলস্বরূপ ১৬মে ল কমিটির কাছ থেকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি পান। এছাড়াও তার স্মৃতি রক্ষার্থে এ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ‘বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপিত হয়েছে, কলকাতায় আধুনিক স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসাবে ‘বিদ্যাসাগর সেতু’ নামকরণ করা হয়েছে।
জীবনবসান
বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় লিভারে ক্যানসার আক্ৰান্ত হয়ে ১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই রাত্রি দুটো আঠারো মিনিটে তার কলকাতার বাদুড়বাগানস্থ বাসভবনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।